Tuesday, November 26, 2013

আমিই সেই মেয়ে --- শুভ দাশগুপ্ত

আমিই সেই মেয়ে।
বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন
যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি
আপনি রোজ দেখেন।
আর
আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন।
আমিই সেই মেয়ে।

বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো
আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে
তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি
আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয়
আপনার রাজকীয় লাম্পট্য
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে
যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে
ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান
যার অনাবৃত শরীর
আমি সেই মেয়ে।

রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি
পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল
হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন
চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা
ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার
চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া
সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো
গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে-
কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার
আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান
আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে
বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে।
আমিই সেই মেয়ে।

সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা।
আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়।
আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়।
আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
কালো আকাশ মাথায় নিয়ে
আমি ছাতা হয়ে থাকি।
ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।

আপনি, আপনারা..
আমার জন্য অনেক করেছেন।
সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে
মা বলে পুজো করেছেন।
প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর
শহর গঞ্জের কানাগলিতে
ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন।
হ্যা, আমিই সেই মেয়ে।
একদিন হয়ত
হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন
আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা !
খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ।
দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন।
কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি।
হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ।
দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি।
নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ।
দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।

বীভৎস দাবানলের মত
আমি এগোতে থাকবো ! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে-
সভ্যতার দেহ
প্রগতির দেহ-
উন্নতির দেহ-
সমাজের দেহ

হয়ত আমিই সেই মেয়ে ! হয়ত ! হয়ত বা।

Monday, November 18, 2013

যাত্রাভঙ্গ --- নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন কর যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে।

নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।

পল্লী-বর্ষা --- জসীমউদ্দীন

আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে-ঘোলাটে মেঘের আড়ে,
কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে-ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব শাখে-নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেনু খুলিয়া দিয়াছে-অস্ফুট কলিকায়।
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে, হেসে কুটি কুটি হয়।
সে হাসি তাহার অধর নিঙ্গাড়ি, লুটায়িছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে, অবিরাম জলধারা।
তারই স্রোতে আজি শুকনো পাতারা, ছুটিয়াছে ঘরছাড়া।

হিজলের বনে, ফুলের আখরে, লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসাইয়া দিয়াছে, না জানি কোন দিঠি।
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায়, জনহীন বন বাঁটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া-কার কেয়া বন ঘাটে।
কোন সে নিরালা বুনো ঝাউশাখে, বুনিয়া ঘোলাবি শাড়ি-
হয়তো আজিও চেয়ে আছে পথে, কানন কুমার তারই।

এদিকে দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল-
পায়ে জড়াইয়া পথে দাড়ায়েছে, আজিকার মহাকাল।

গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আজি-মোড়লের দলিজায়,
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে-আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখাড়ি চাছিছে, কেউ পাকাইছে রশি।
কেউবা নতুন দুয়ারির গায়ে, চাকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে, সুন্দর করে ফুল।
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।

মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুন ভাটির সুরে-
আমির সাধুর কাহিনি কহিছে, সারাটি দলিজা জুড়ে।
লাঠির উপরে, ফুলের উপরে, আকা হইতেছে ফুল-
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে, বাজিতেছে নির্ভুল।
তারই সাথে সাথে গল্প চলছে-আমির সাধুর নাও,
বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার-ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুকা ও চলিয়াছে ছুটি-এর হাতে ওর হাতে,
নানান রকম রশি বুনানো-হইতেছে তার সাথে।

বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুড়ু গুড়ু মেঘ ডাকে।
এসবের মাঝে রুপকথা যেন, আর রুপকথা আঁকে।
যেন ও বৃদ্ধ গাঁয়ের চাষিরা-আর ওই রুপকথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে-আরেক কল্পলতা।
বউদের আজ কোন কাজ নাই, বেড়ায় বাধিয়া রশি,
সমুদ্র কলি শিকা বানাইয়া-নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া, বুকের স্বপ্ন খানি-
তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতার-মায়াবি আখর টানি।

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন, ছল ছল জলধারে-
বেনু বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে

Friday, October 25, 2013

স্বাধীনতা আমার ভালো লাগেনা”/ সুখপাঠ্য নয় তবে প্রয়োজনীয় পাঠ্য

সংগ্রহ পর্ব

এটিএন নিউজের নিউজ এবং কারেন্ট এ্যফেয়ার্স এডিটর প্রভাষ আমিনের লেখা বইয়ের নাম “স্বাধীনতা আমার ভালো লাগেনা” যদিও নামটি পড়ে কারোই বোঝার সাধ্য নেই এটা আসলে কিসের বই‍!!! নামের মধ্যেই দারুন নাটকীয়তা। তার চেয়েও বড় নাটকের জন্মদিয়ে বইটি আমার হস্তগত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩’র একুশে বই মেলায়, কিন্তু আমার তখন বইটি কেনা হয়ে ওঠেনি। এরপর প্রভাষ’দার নিয়মিত রিমাইন্ডারের ফলে একদিন সত্যি সত্যি বইটি কেনার জন্য হাজির হলাম আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানে। কিন্তু হাজির হলেই তো আর হবেনা, সেখানে তো বইটি পেতে হবে! সব দোকান খুঁজে পেতে যখন প্রায় কনফিউজড (এরই মধ্যে আমি আরো দুটো বই কিনে ফেলেছি এবং নির্ধারিত বই কেনার টাকা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তখন প্রভাষ’দা জানালেন তার বইটি আজিজে পাওয়া যাবেনা। একটি এজেন্সির নাম জানিয়ে বললেন, অনলাইনে অর্ডার দিলে তাঁরা পৌছে দেবে। কিন্তু আমার তক্ষুনি বইটি চাই চাই… কারন আমার আশংকা ছিল সেই বই আমার হাতে আসতে আসতে হয়তো আমি বাকি টাকা শেষ করে ফেলবো :P । শেষে দাদা জানালেন, হয়তো কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে ঐতিহ্যের শোরুম আছে যেখানে বইটি পাওয়া যেতে পারে। এরপর অভিযান কাটাঁবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে…ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি! আপনারা হয়তো ভাবছেন, কি আছে সেই বইএ? কি জানতে পারবেন বইটি পড়ে? হ্যাঁ ক্যনভাসারদের মত বলতে পারি, এই বইটি পড়লে জানতে পারবেন… 

থাক, সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসি। আগে সেই বই কেনার কাহিনী শেষ করি। কনকর্ড এম্পোরিয়ামে পৌছে, এই দোকান সেই দোকান ঘুরে (বই এর দোকানে ঘুরতে খুব একটা খারাপ লাগেনা। দোকান পুরোনো হলে একটু হাচিঁ টাচি হয়, তবে এই মার্কেটের দোকান গুলো ঝা চকচকে) আমি যখন ঐতিহ্যের দরজায় পৌছালাম তখন দেখি দরজা বন্ধ  :( পাশের দোকানী বললেন, বন্ধনা, ওই দোকানের লোক নামাজ পড়তে গেছে। আমি আর কি করি, যে দোকানগুলো ঘোরা বাকি ছিল সেগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম পরিচিত এক ভাইকে, যার সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা। অনেক অনেক গালগল্প শেষে আবার ফিরলাম ঐতিহ্যে এবং বইটিও খুঁজে পেলাম… :)।

যারা ভাবছেন যাক!!! শিবেরগীত অবশেষে শেষ হলো তাদের আশাহত করে জানাচ্ছি পিকচার আবভিবাকি মেরে দোস্ত ;) ।

বইতো পেলাম, কিন্তু বই’র দাম দেখেতো আমার চক্ষুস্থির ৩ শত ৭৫ টাকা মাত্র। কমিশন টমিশন কি কি সব বাদ দিয়ে, ২ শত ৮০ টাকা। আচ্ছা ঠিক আছে মারি তো গন্ডার লুটিতো ভান্ডার এই ভেবে মানি ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি আমি ইতোপূর্বে আরো ৩ টি বই কিনে টাকা খরচ করে ফেলায়, কিছু টাকা কম পড়ে যাচ্ছে। আর বইটারও এমনই কপাল,সবসময় ব্যাগের বিভিন্ন চিপা চাপায় খুঁজলে কিছু না কিছু বের হয় অথচ সেদিন একটি ফুটো পয়সাও বেরোলোনা। কয়েকটি টাকার অভাবে বইখানি আবার শেলফ’এ রেখে ফিরে এলাম আর দোকানীকে কথা দিয়ে এলাম পর দিন অবশ্যই আমি বইটি সংগ্রহ করবো। এর মধ্যে আবার প্রভাষ’দা :( … জানালাম বিশেষ জটিলতার কারনে বইটি সংগ্রহ করা হয়নি এবং তাকেও একই আশ্বাস দিলাম পরদিন নিশ্চই আমি বইটি সংগ্রহ করবো। ভদ্রলোকের ১ জবান, নড়চড় নাই। সেজন্যই বইটি আজ আমার আশে পাশেই মহা আনন্দে গড়াগড়ি খায়।


অবশেষে আমি বইটি শেষ করেছি
বইটি কিনে বাসায় পৌছাতে যতটুকু সময় ঠিক ততটুকু সময় পরেই বইটি পড়া শুরু করেছিলাম... নাহ্ একটু ভুল হলো, পড়তে শুরু করার আগে বেশ খানিকটা সময় হাতে নিয়ে বইটি উল্টে পাল্টে গবেষণা করেছি। গবেষণা করার অনেক কারন ছিল। এটা সেই বই, যে বই আমি রীতিমত অনুসন্ধানী অভিযান চালিয়ে কিনেছি :D ... যেই বইটার জন্য কেবল বইয়ের লেখক নন আমার জানা চেনা আরো অনেকেই প্রচার চালিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম চ্যানেল আই’র নিউজ এডিটর জাহিদ নেওয়াজ খান। প্রথমে তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা খানিকটা আন্দাজ করেছি। কিন্তু বইটিতে লেখকের ভুমিকা পড়ে বুঝলাম আমার আন্দাজ ভুল নয়। মুখবন্ধে মুন্নী সাহার লেখাটি পড়ে বুঝতে পারলাম প্রভাষ’দাকে আসলে সবাই ভীষন পছন্দ করে। তিনি যে মিশুক, বন্ধুবৎসল এটা আগেই জানা ছিল। দারুন সেন্স অব হিউমারের অধিকারী এটাও আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু তা যে এতটা তা আগে বুঝতে পারিনি। পড়া শুরু করতেই বুঝলাম এই বইয়ে স্থান পাওয়া অনেক গুলো লেখা আমি আগেই পড়ে ফেলেছি। এখানে প্রশ্ন করাই যেতে পারে তাহলে… তাহলে শুধু শুধু আমি বইটি কেন কিনলাম!?! এই প্রশ্ন মনে আসাই স্বাভাবিক। এই উত্তরের আগে ছোট্ট করে বলে রাখি অটোগ্রাফ কাহিনীটা। বইটি কিনে আগে প্রভাস'দা কে একটা ধন্যবাদ দেই কারন তাঁর কল্যাণেই বইএর একটা চমৎকার মার্কেট খুঁজে পেলা। জবাবে তিনি জানান, "বেশতো রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হলো।" আমি উত্তর দেই " নাহ কলা কিনতে গিয়ে পুরো কলা বাগান পেয়ে গেলাম B-) ।" এ কথা কেন বললাম সেটা প্রভাষ'দার অটোগ্রাফ নোটটা দেখলেই বোঝা যাবে।

পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম এতো কাহিনী করে বইটি কিনে আমি একটুও ভুল করিনি। এই বইকে মোটেও কাঁচকলা বলে অবজ্ঞা করার অবকাশ নেই… বরং আমাদের প্রজন্মের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় একটি বই। আজ থেকে দুই দশকেরও বেশি সময় আগে একজন তরুণ তার সময়টাকে কিভাবে দেখতো বিচার করতো সেটা যেমন বোঝা যায় তেমনি সেই সময়টা কেমন ছিল সেটাও জানতে পারা যায়। পড়তে পড়তে আমার চোখে গণমাধ্যম, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা, সচেতনতার তখন আর এখন ঠিক যতটা ধরা পড়েছে, তেমনটাই জেনেছি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সেই আন্দোলনে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা, এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে এক তরুণ গণমাধ্যম কর্মীর ভাবনা। আবার চিত্রপটের ভিন্নতায় সেই তরুণকে দেখতে পাই একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে মানসিক ভাবে যথেষ্ট পরিপক্ক অবস্থায় আমাদের বয়সের তার সময়কে বিচার বিশ্লেষন করতে।

কেবল সেই সময় এই সময়ই না, সমসাময়ীক বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষন খুঁজে পাই একজন সচেতন মানুষ এবং সমান্তরাল ভাবে একজন সাংবাদিকের চোখে। এসব ঘটনার খুটিনাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি এমন আরো বিভিন্ন বিষয়কে তুলে এনেছেন যা কিনা একজন সংবাদকর্মীর জানা থাকা আবশ্যক। বিভিন্ন সময়ে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতেই, প্রতিটি সংবাদকর্মীর পালন করা উচিত এই বিষয়গুলো।লেখক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে মিডিয়ার অসচেতনতার যেমন কড়া সমালোচনা করেছেন পাশাপাশি মিডিয়া সচেতন এবং শক্তিশালী হলে কি কি অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলা যায় সেটাও উদাহারণসহ ব্যাখ্যা করেছেন। তথ্য বহুল এই বইটি তাই কেবল পড়লেই হবেনা, সংগ্রহেও রাখতে হবে।

সাংবাদিকতা পেশাকে তীব্র ভাবে ভালোবেসে এক তরুণের সংবাদকর্মী হয়ে ওঠার অনেক ছোট ছোট গল্পের সঙ্গে সেই তরুণের শিশুকাল থেকে গড়ে ওঠা অনেক ভাবনা এবং জীবন দর্শনও বিভিন্ন অলিগলি আর চোরা পথে এসে মিলে গেছে লেখার মাঝে। এই বৈচিত্রর ফলে বইটি পড়তে যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোকে লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা থেকে আনন্দ নিংড়ে নেয়ার যে অসাধারণ বর্ণনা আছে তাতে কেবল লেখকের উদার দৃষ্টি ভঙ্গি প্রকাশ পায় তা নয়, বোঝা যায় তাঁর অসামান্য প্রাণ শক্তি।

তাই ব্যক্তিগত যায়গা থেকে আমি বলতে পারি বর্তমান সময়ে যেকোন অনাকাংঙ্খিত পরিস্থিতিতে প্রভাষ আমিনের একটি বিশ্লেষন ধর্মী লেখার জন্য আমি যেমন করে অপেক্ষায় থাকি, ঠিক সেভাবেই অপেক্ষা করছি পরের বইটির জন্য।


পুণশ্চ: বইটি পড়া শুরু করলেই বোঝা যাবে, বইটি পড়তে আমি এত সময় কেন নিয়েছি.... এটা গোগ্রাসে গেলার মত কোন বই না। এটা অনেক ধীরে সুস্থে পড়তে হবে। কারন এই বইয়ের অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে.... :)

কনিফউশান

ঈদে বা ছুটি ছাটায় যাতায়াত সময় বাচাঁতে আমি ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভেঙে ভেঙেই খুলনা যাই। এজন্য টিকিট নিয়ে খুব একটা তোড়জোড় থাকেনা। উদ্দেশ মানে যদি destination না ধরে plan ধরা হয় তবে আমার এই যাত্রাকে অনেকটাই নিরুদ্দেশ যাত্রা বলা যায়। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি! ৭ তারিখে অফিস করে তাড়াহুড়া করে পিঠে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে দৌড় দিলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। গুলিস্তান থেকে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে লাইন দিয়ে বাসে উঠলাম। এখানে ভাগ্য খানিকটা িসুপ্রসন্ন ছিল, টিকিট লাইনের সামনের দিকে থাকা একজন, আমি একা দেখে দয়া পরবশত হয়ে আমার টিকেট খানি কেটে দিলেন। ভালোয় ভালোয় শুরু হলো যাত্রা। ছোটখাট কিছু বিড়ম্বনা পেরিয়ে আমি যখন মাওয়া ঘাটে পৌছালাম ঘড়ির কাঁটা তখন ৬ টা ছুঁই ছুঁই। ছুটতে ছুটতে লঞ্চ ঘাটে গিয়ে দেখি মানুষের উপচে পড়া ভীড়। সময় নষ্ট না করে ছুটলাম ফেরির দিকে। এখানেও কপাল ভালো ছুটতে ছুটতে উঠে পড়লাম সেই ফেরিটায় যেটা ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মাওয়া রুটে সব সময় লঞ্চে নদী পার হই, এই প্রথম এই রুটে ফেরিতে পার হচ্ছি একা একা। তাই প্রথমেই মাথায় কাজ করছিল সুইটেবল একটা জায়গা খুঁজে বের করা যেখানে নিষ্চিন্ত হয়ে বসা যাবে এবং ইফতার করা যাবে। ফেরিতে উঠে তেমন একটা জায়গা পেয়েও গেলাম। আমার আশেপাশে ৬/৭ জোড়া দম্পতি তাদের আন্ডা বাচ্চাসহ ২০/২৫ জনের একটা দল ছিল। আর ছিল কিছু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে, মনে হচ্ছিল হয়তো কাছাকাছি বাড়ি তাই সবাই একসঙ্গে মজা করতে করতে যাচ্ছে। জায়গা পেয়ে স্থির হয়ে বসে দেখলাম চারপাশে ইফতার নিয়ে বেশ একটা হুলস্থল ভাব... দম্পতিদের পুরুষগুলো ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ইফতার কিনে আনছে। তখন আমার মনে পড়লো ইফতার কেনা হয়নি। ফেরিতে ওঠার তাড়ায় ইফতারি কেনার কথা মনে ছিল না, আর পথে কিছু কিনে নেবো ভেবে পানি আর কিছু ফল ছাড়া আর খাবার আর কিছুই সঙ্গে নেইনি। কিছুক্ষনের মধ্যেই ফেরি ছেড়ে দেবে তাই নামাও যাবে না, অগত্যা দম্পতিদের এক নারীকে ব্যাগের পাহারায় রেখে ফেরিতে কিছু পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখতে গেলাম। পাটুরিয়া রুটের ফেরিতে ভালোমন্দ অনেক কিছু পাওয়া গেলেও মাওয়া রুটের ফেরির অবস্থা দেখলাম একেবারেই করুন... :( এক প্যাকেট বেঙ্গল বিস্কুট আর এক প্যাকেট প্রাণ মুড়ি কিনে বসার জায়গায় ফিরে দেখলাম জায়গা প্রায় বেদখল। কোন রকমে আবার জায়গা পূরুদ্ধার করে বসে চারপাশে মনোযোগ দিলাম।তখনই প্রথম মনে হলো ইশশশ সাথে আরেকজন থাকলে কত ভালো হত... আমার পাশে থাকা জুটিদের ছেলেগুলো আয়োজন করে ইফতার রেডি করছে, ছোলা, পেয়াঁজু, বেগুনী... আরো কতকি... তখনই মনে হলো কী এমন ক্ষতি হতো এমন কেউ সঙ্গে থাকলে :( প্রায় দুই ঘন্টা ফেরিতে দেখি একটু পর পর এটা সেটা কিনে আনে, আমি চুপচাপ দেখি... দেখি আর মন খারাপ করি... মন খারাপ করি আর ভাবি.... ভাবি আর ভাবি আমার কেন এমন লাগে??? আমার কেন মন খারাপ হয়? বিষয়টা একটুও পছন্দ হচ্ছেনা... কিন্তু তাও মন কেমন করছে স্ট্রেইঞ্জ!!! ওদিকে আমি আর ফেরি এগিয়ে চলে। চলতে চলতে ফেরি যখন তীরের কাছাকাছি চলে আসে ততক্ষনে ঘড়ির কাটা আটটার ঘর ছুঁই ছুঁই... ব্যাগ বোচকা নিয়ে আমি নামার জন্য রেডি। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। তখন আমার মাথায় কেবল একটা চিন্তা, খুলনা পর্যন্ত কি করে পৌছাবো। তবে এর মধ্যে একটা কথা ঠিকই মাথায় উঁকি দিয়ে ছিল, সঙ্গে কেউ থাকলে আমাকে নিশ্চই এভাবে লাফিয়ে ঝাপিয়ে নামতে দিত না... :P

লঞ্চ থেকে নেমে অনেকটা হাটার পথ। একদম সিনেমা নাটকে দেখা যায় যেমন, ঠিক তেমন ঘুট ঘুটে অন্ধকার পথ। রাস্তার দুই পাশে দোকান-টোকানও নাই... আলো বলতে কেবল কিছু সময় পর পর ফেরি থেকে নামা এবং বিপরীত থেকে আসা দু’একটা গাড়ি আর মোটর সাইকেলের আলো। সে আলো অন্ধকার কমানোর চেয়ে বরং বাড়িয়ে দিয়েই যায়। কে না জানে, অন্ধকারে আলো জ্বলে আবার নিভে গেলে অন্ধকার আরো বাড়ে। যাই হোক, রাস্তায় মাঝে যে দু’এক জন লোকের দেখা মিলছিলো তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে পথ চলছিলাম। তাদের কাছে জানতে চাইছিলাম খুলনায় যাবার বাস বা মাইক্রোবাস কোথায় পাবো তারা উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সম্পুরক প্রশ্ন করছিলেন... “আপনি একা?” “আপনার সাথের লোক কই আম্মা?” “আপনার সাথে আর কেউ নাই?” এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমি যখন ঘাড় উচুঁ করে “নাহ আমার সঙ্গে কেউ নাই, আমি একা” বলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন টের পাচ্ছিলাম পেছন থেকে আমাকে অনুসরন করছে কয়েক জোড়া অবাক চোখ। নাহ্ আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি সেই দৃষ্টিতে কোন লালা ঝরছিল না, রাগ, বিরক্তি বা অন্য কিছুই নয়। নারীর সহজাত যে অনুভূতি বোধ তাতেই আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে অনুসরেন করা ওই চোখ গুলোয় ছিল বিস্ময় আর ছিল সমিহ আর শ্রদ্ধা। নিজের প্রতি, নিজের অবস্থানের প্রতি ভালোবাসা আরেকটু বেড়ে গেলো। পাশে কেউ না থাকলেও, অন্যকারো উপর নির্ভর না করেও এই জীবনটা বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দেয়া যে সম্ভব, এবং এখনো সমাজের সব মানুষ যে পচেঁ যায়নি এটা অনুভব করতে পেরে বেশ ভালো লাগছিল :)

বাস পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। আমি পৌছানো মাত্রই পেয়ে গেলাম একটা বাস, কাঙ্খিত সিট ও পেয়ে গেলাম যদিও তা ছিল একদম পেছনে। সব গুছিয়ে বসলাম নিশ্চিন্ত মনে; কারন আর কোন ঝামেলা না হলে এই বাসটিই আমাকে পৌছে দেবে আমার কাঙ্খিত গন্তব্যে। নিশ্চিন্তে বসে, সারাদিন রোজা থাকার ক্লান্তিতে বেশ একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। একে তো ভীষন ক্লান্ত তার উপর চলন্ত বাসের ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে মাথাকে আর সোজা রাখতে পাছিলাম না। তখন আবার মনে হল নাহ পাশে একটা কাধ থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো? নিশ্চিন্তে অন্তত মাথাটা েরাখা যেত। সেই ঘুম ঘুম চোখেই তখন মাথায় আসে, আসলে আমরা কিসে তৃপ্ত... ওপর থেকে যতগুলো কথা লিখেছি সব কথাগুলো একে একে তখই মাথায় আসে। এই যে আমার রানীর মত জীবনটা এই জীবনটার প্রেমে আমি পড়তে চাইনা। বিগত সময়ে বুঝে গেছি সেটা আমার, আমার পরিবার সর্বপরি সমাজের জন্য ততটা গ্রহনযোগ্য এবং স্বাস্থ্যকর নয়। আবার এই জীবনটা হারিয়ে ফেলতেও আমি ভীষন ভয় পাই...

Sunday, October 6, 2013

শাড়ি---সুবোধ সরকার

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।

আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘ তোর নাম অভিমান’
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কি করে এক জীবনে পড়বে ?

কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সন্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে ।
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডান দিকে ।
যাকে বলে এল ।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিস থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে ।
এর নাম রাজনীতি, বলেছিল পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা।
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।

কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা….

Friday, September 13, 2013

স্মৃতিময় শারদীয় হাওয়া -- সৈয়দ শামসুল হক

সে কী বিস্ময়! কী যে বিস্ময়! কী করে ভুলি!
আকাশের নীল ঘন শাদা মেঘ, কবেকার গ্রামপথে ডুলি!
নাইওরে যাচ্ছে বউ! একদিন চুল তার—
দেখি নাই কারও চুল দীর্ঘ এতটা—
বিস্ময় সে কী! আর চুলে নক্ষত্রের ফোঁটা—
কত লক্ষ! এক লক্ষ! দাবানল লাগা বনের সেই অগ্নিকণা—
ভুলব না! কিশোরের ঘুড়ি হাতে উড্ডীন উন্মাদনা!
এখনো কী বিস্ময়ে বিমূঢ়!
মনে করে দ্যাখো সেটি—মেধাবী কাঁধের ওপরে মুড়ো
খসে পড়ে যেতে চাইছে আকাশের ধবল নীল প্রান্তরে—
আর অগ্নিতে চোখের তারা পোড়ে!
আজ এই নগরের অ্যাভেনিউয়ে এসে যেই দাঁড়ালাম—
সেদিনের কিশোর বেলাকার এই আমাকে বললাম—
ওরে থাম! থাম!

দ্যাখ সেই একই ছবি, সেই মেঘ,
সেই নীল, অগ্নি সেই একই!
আজও তো হঠাৎ—সেদিন গ্রামের নয়—
তোমাকেই আজও দেখে উঠি!—
যদিও জীবন হয়ে গেছে যেন বাসি পাউরুটি!
তবু এ আকাশ আর সেদিনের আকাশ নিচে যে হঠাৎ আমি—
কোনোটাই নয় কোনোটির চেয়ে এতটুকু কম দামি!
শুধু প্রতীকের হেরফের—ঢের!—
আর বয়সের গড়িয়ে যাওয়া!
স্মৃতির পাতা উড়ে যায়—কত দূরে বা কোথায়!—
মুখ পরে মুখ!—কত মুখ ওড়ায়!
আজও তো ওড়াতে থাকে পূর্বাপর উদাসীর
বিপুল মত্ত অস্থির
ইতিহাস আর সেই ঘন নীল শাদা শাদা শারদীয় হাওয়া।

Friday, September 6, 2013

চিল্কায় সকাল --- বুদ্ধদেব বসু

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।

গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের
ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?
রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে।
-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ
ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর
আমার
কী ভালো লেগেছিল।
তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ।

দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।

Wednesday, August 28, 2013

সোনালী ডানার শঙ্খচিল---জীবনানন্দ দাশ

মনে পড়ে সেই কলকাতা–সেই তেরোশো তিরিশ–
বস্তির মতো ঘর,
বৌবাজারের মোড়ে দিনমান
ট্রাম করে ঘরঘর।
আমাদের কিছু ছিল না তখন
ছিল শুধু যৌবন,
সাগরের মতো বেগুনি আকাশে
সোনালি চিলের মন।

ছেঁড়া শাড়ি পরে কাটাইতে দিন
বাঁটনা হলুদ মাখা
বিভারানী বোস, তোমার দু হাতে
ছিল দুটো শাদা শাঁখা,
শাদা শাঁখা শুধু তোমার দু হাতে
জুটিত না তেল চুলে,
তবুও আমরা দিতাম আকাশে
বকের পাখনা তুলে।

জুটিত না কালি কলমে আমার
কাগজে পড়িত টান,
তোমার বইয়ের মার্জিনে, বিভা,
লিখিতাম আমি গান।
পাশের বাড়ির পোড়া কাঠ এনে
দেয়ালে আঁকিতে ছবি।
আমি বলিতাম–’অবন্তী-বিভা’,
তুমি শুধাইতে ‘ঈগল কবি’

চক্ষে তোমার মিঙ্ যুগ ভাসে
কাঙড়ার ছবি ঐ নীল চোখে
আমার হৃদয়ে অনুরাধাপুর
পুরানো ফরাসি গানের বোকে
সেদিন আমার পথে পথে হাঁটা
সেও তম্বুরা মান্ডলিন
তোমার সেদিন ঘর সিঁড়ি ভাঙা
বাংলার পট, পুরোনো চীন।

পৃথিবীর মুখে তুড়ি দিয়ে দিয়ে
দুইটি হৃদয় সেই
ডাল তেল নুন জোটে না যাদের
জামা-শাড়ি কিছু নেই,
তবুও আকাশ জয়ের বাসনা
দু:খের গুলি সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল—

শরীরের ক্ষুধা মাটির মতন
স্বপ্ন তখন সোনার সিঁড়ি,
মানুষ থাকুক সংসারে পড়ে
আমরা উড়িব পৃথিবী ছিঁড়ি।

সকাল হয়েছে: চাল নাই ঘরে,
সন্ধা হয়েছে: প্রদীপ নাই,
আমার কবিতা কেউ কেনে নাকো?
তোমার ছবিও ঘুঁটের ছাই?

ছ মাসের ভাড়া পড়ে আছে না কি?
ঘরে নাই তবু চাল কড়ি নুন?
আকাশের নীল পথে পথে তবু
আমার হৃদয় আত্তিলা হূণ
আকাশের নীল পথ থেকে পথে
জানালার পর জানালা খুলে
ভোরের মুনিয়াপাখির মতন
কোথায় যে দিতে পাখনা তুলে।

সংসার আজ শিকার করেছে
সোনালি চিলেরা হল শিকার,
আজ আমি আর কবিতা লিখি না
তুমিও তো ছবি আঁকো না আর।
তবুও শীতের শেষে ফাল্গুনে
মাতাল যখন সোনালি বন
তেরোশো তিরিশ—দারিদ্র্য সেই
ফিরে চাই আজ সে যৌবন।

ফিরে চাই আমি তোমারে আবার
আমার কবিতা, তোমার ছবি—
শুধাতাম আমি ‘অনুরাধাপুর’—
শুধাইতে তুমি ‘শকুন কবি’।
সেই-যে আকাশ খোঁজার স্বপ্ন
দুখের ছররা—সে যেন ঢিল,
আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে
সোনালি ডানার শঙ্খচিল।

Wednesday, August 7, 2013

পাহাড় চূড়ায়- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।

নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,
ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার
কাছে মাপে ছোট লাগলো। প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু
একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়
একটা নদী পেয়েছিস?
খুব জিতেছিস তো মাইরি!
তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।
তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।
নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।
যেমন, বলো তো, আজ
সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?
সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,
সে জানতো! সবাই জানে।
শৈশবে আর ফেরা যায় না।

এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ
শুনতে পাবে না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো। 

Tuesday, August 6, 2013

কথা ছিলো---আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

যতো দূরে আকাশ ছুটে নক্ষত্রের মাঝে
নদীর জল পাখির মতো উড়ে উড়ে
যতো দূর গিয়ে মোহনায় মিশে
হারায়ে যায় বিশালতায়, সাদা সব ফুলের
সুবাসের প্রণয়ে ভোমরা যতো দূর গিয়ে
নিষেক প্রেমে সিক্ত হয়,
তত দূরে চলে যাবি যদি
কাদেঁ কেন তবে মন?
সীমানার ঐপারে নির্জনায়
বিকেলে একা একা বসে
বিরহের আসন পেতে সুখের উত্তাপ
শীতের মাঝে যদি খুজবেঁই
কেন তবে আড়াল দিলে
বুঝিবে না তয়,
এ কেমন পাতা ঝরা!!
হৃদয়ে ঝরে নিঃসীম সুতীব্রতায়
সকরুণ
হৃদয়প্রতীম আজীবন ব্যথার দান!!!!

Friday, July 26, 2013

সাধারণ মেয়ে ---- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি অন্তঃপুরের মেয়ে,
           চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু,
               "বাসি ফুলের মালা'।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণ-দশা ধরেছিল
               পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল তার রেষারেষি,
        দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে--
               জিতিয়ে দিলে তাকে।
    নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
    একজনের মন ছুঁয়েছিল
           আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
        তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে--
    ভুলে গিয়েছিলেম, অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি।
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
        অল্পবয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।
        তোমাকে দোহাই দিই,
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
           বড়ো দুঃখ তার।
        তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
           কেমন করে প্রমাণ করবে সে,
        এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
        মন যায় না সত্যের খোঁজে,
    আমরা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।
    কথাটা কেন উঠল তা বলি।
        মনে করো তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
    এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব যে সাহস হয় না,
           না করব যে এমন জোর কই।
    একদিন সে গেল বিলেতে।
           চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
    মনে মনে ভাবি, রাম রাম! এত মেয়েও আছে সে দেশে,
           এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়!
        আর তারা কি সবাই অসামান্য--
               এত বুদ্ধি, এত উজ্জ্বলতা।
    আর তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
           স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।
    গেল মেলের চিঠিতে লিখেছে
           লিজির সঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে--
        বাঙালি কবির কবিতা ক' লাইন দিয়েছে তুলে
           সেই যেখানে উর্বশী উঠছে সমুদ্র থেকে--
               তার পরে বালির 'পরে বসল পাশাপাশি--
    সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
               আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।
        লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
    "এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে;
           ঝিনুকের দুটি খোলা,
               মাঝখানটুকু ভরা থাক্‌
        একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে--
           দুর্লভ, মূল্যহীন।'
        কথা বলবার কী অসামান্য ভঙ্গি।
সেইসঙ্গে নরেশ লিখেছে,
    "কথাগুলি যদি বানানো হয় দোষ কী,
           কিন্তু চমৎকার--
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়।'
           বুঝতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো
    আমার বুকের কাছে বিঁধিয়ে দিয়ে জানায়--
           আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
    মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
        এমন ধন নেই আমার হাতে।
    ওগো, নাহয় তাই হল,
        নাহয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,
        নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প--
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
        অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে--
           অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
        হার হয়েছে আমার।
কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে
        তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,
           পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
    ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।
        তাকে নাম দিয়ো মালতী।
           ওই নামটা আমার।
           ধরা পড়বার ভয় নেই।
    এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
           তারা সবাই সামান্য মেয়ে।
               তারা ফরাসি জর্মান জানে না,
                   কাঁদতে জানে।
           কী করে জিতিয়ে দেবে।
    উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
        তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে,
           দুঃখের চরমে, শকুন্তলার মতো।
               দয়া কোরো আমাকে।
           নেমে এসো আমার সমতলে।
        বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কাছে যে অসম্ভব বর মাগি--
           সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
    রাখো-না কেন নরেশকে সাত বছর লণ্ডনে,
        বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
           আদরে থাক্‌ আপন উপাসিকামণ্ডলীতে।
        ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম| এ|
               কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
        গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
           কিন্তু ওইখানেই যদি থাম
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
    আমার দশা যাই হোক
        খাটো কোরো না তোমার কল্পনা।
    তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
    সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
           যারা কবি, যারা শিল্পী, যারা রাজা,
           দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যোতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে--
           শুধু বিদুষী ব'লে নয়, নারী ব'লে।
ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে
    ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয়--
        যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
               আছে ইংরেজ জর্মান ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না,
        বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
        মাঝখান দিয়ে সে চলেছে অবহেলায়--
               ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকো।
        ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি,
সবাই বলছে ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
           মিলেছে ওর মোহিনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জনান্তিকে বলে রাখি
           সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
               বলতে হল নিজের মুখেই,
        এখনো কোনো য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
               সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)
        নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে,
    আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।
           আর তার পরে?
তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল,
        স্বপ্ন আমার ফুরোল।
           হায় রে সামান্য মেয়ে!
               হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়!
  ২৯ শ্রাবণ, ১৩৩৯

Sunday, July 7, 2013

রূপকথা --- আহসান হাবীব

খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।

Friday, June 7, 2013

সুধা! --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

ভস্ম অস্পৃষ্ট
অ-অন্বিষ্ট দৃষ্টি ;
হাহাকার বোধ দ্বন্দ্ব
আহ্লাদ অংকুরে ঝরে!
অচিন পাখি
কোন সুরে গায়-
মেলায় যায় মিলায়ে!
গহীনের বাণী__ফুটে
তবে ফুলে!

জুন ২০১২

Sunday, June 2, 2013

একেই বুঝি মানুষ বলে --- সৈয়দ শামসুল হক

নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।

বৈশাখী রাত্রির আগমনে --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

বৈশাখের ঝাপটায় জল-ধুলোয় একাকার
পড়ন্ত বিকেলে আলস্যে বৈশাখী হাওয়া
চারিপাশে, ছুয়েঁ যায় বৃষ্টির রাশি
আকাশ গর্জে এলো বৃষ্টি
পড়ন্ত বিকেলে ঝরছে আবেগ, ভালোলাগা
বৃষ্টির ভাজেঁ ভাজেঁ ঝরছে প্রেম
ভিজেঁ একাকার তুমি,আমি আর প্রেম
বৈশাখী এই রাত্রির আগমনে। 
.......................

২ বৈশাখ ১৪১৯, ১৫ এপ্রিল ২০১২

অন্যকথা --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

একদিন কথা ছিলো, অনেক অনেক কথা হতো
আজ কেন জানি কোন কথা নেই। 
একদিন অনেককিছুই আপন ছিলো 
আর এখন দূরযামী, দূরের জানি।
একসময় অনেকের কাছের কেউ ছিলো 
শূন্য ঘর ভরে ছিলো অনেকের আনাগোনায়
একেকদিন সন্ধ্যা কেমন দৌড়ে যেতো রাতে
এখন সব সময় সুদীর্ঘ
কথাহীন শব্দহীন দীর্ঘ বেলা যতো
একদিন তবে জীবন অন্যরকম!!
.......................

১১ চৈত্র, ১৪১৮, ২৫ মার্চ ২০১২

তোমার মাঝে আমারে দেখিনি বলে অন্ধ আজ --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

রাত্রির প্রেম কোন নিকুঞ্জবনে
জলের আরশিতে খুজেঁ খুজেঁ
স্বপ্ন সকাল সুর্য আলোর ঝলকানি 
নিশ্চহ্ন নতুনে পাখনায়
ভুলে যাই স্বপ্নে আকাঁ সময় 
পড়ন্ত বিকেলের সাথে সন্ধি করেনি
দুপুরের রোদের সোনালি ক্ষণ
গোধূলী রঙে অ-অনুরূপ
রাত্রির প্রেম কোন নিকুঞ্জবনে
জলের আরশিতে খুজেঁ খুজেঁ
স্বপ্ন সকাল সুর্য আলোর ঝলকানি 
নিশ্চহ্ন নতুনে পাখনায়
..........................


২০ মার্চ ২০১২

ভেলা ভেসে যায় --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

সেই আকুল দৃষ্টি, আনচান ভাব
বুঝি সে গেছে দূরে
সেই উন্মীলিত আবেগ অনভূতি জাগে না 
বসন্তের আলোড়নে
অন্যরূপে অন্যভবে মিশেছো আলিঙ্গনে
আর হয়তো বলবে না কথা
তথাপি হৃদয় ভাবে

১৮ মার্চ ২০১২

সন্ধ্যায় স্মৃতি --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

ফিঁকে হয়ে আসা স্মৃতিরা
জেগেছে শোধ নিবে বলে
অনেক দেনা
পাওনার খাতা শূণ্য গোল
অনেক আকুতির পর জেগেছে
জীর্ণ ঝরা মলিন স্মৃতিদের কথা প্রশ্ন
অনেক আকাঙ্খা পর ফিরত চায়
এতোদিনের জমা সব দেনার শোধ নিবে
বলে, আর কতো? 
ভাবেনি এইখানেও অনেক পাওনা অদেয়!!

১ চৈত্র,১৪১৮..১৫.৩.২০১২

আমি এখন তোমার কাছে --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

অগোচরে করেছ আপন
কেড়ে নিয়েছ আমায়
বসিয়েছ হৃদয় আসনে
সব ভুলে

তোমার নিবার্ক ঠোটঁ,
বিষন্ন দৃষ্টি,
অবাক চাহনি,
নির্ঘুম রাত,
এলো চুল,
ক্ষীণ ঝিমুনি,
ভাবনা, প্রকাশ
আকাঁবুকি
লোককছাপা
দ্বিধা-দ্বন্ধ,
বোধ,
সব বলে দেয়
আমি তোমার

জানে আকাশ বুঝে হাওয়া
বুঝে অগ্রহায়ণের ফসলের ক্ষেত,
নির্মল ফুল,

পার না ফেরাতে হৃদয়ের টান
ছুটে অবিরত
পার না যেতে দূরে
তোমার মাঝে আরেক তুমি
শুধু আমারেই ভাব
তুমি তা পার না এড়াতে
শত চেষ্টাতেও
আমার ভাবনাই করে বিচরণ

অজান্তেই
আমারে করেছ আপন


১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ বিকাল ৫:৩১

(অসম্পাদিত)

পথিক --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

একবার এক নক্ষত্রকে বলেছি, তুমি কি সুখী/
সে বললো তোমরা সবাই এমনই প্রশ্ন করো কেন?
বললাম আমি কে ?
সে বললো এই অনন্তের পথের পথিক তুমি, বয়ে যাও।
আবার বললাম সুখ কি,
নক্ষত্র বললো বয়ে যাওয়া, তবুও মন ভরলো না,
সে আরো কি জানি বললো আর আমার কান্না আসলো

৩ জৈষ্ঠ্য ১৪১৯, ১৭ মে.২০১২.দুপুর

নীরবানুভূতি --- আশরাফ সিদ্দিকী বিটু

বিশালতার মূর্ত প্রতীক
বিমুগ্ধতায় দূর হতেই বুঝেছি উদারতা,
সবাক নির্বাক কতকিছুর সমারোহ,
পাহাড়, নিবারিত হয় তৃষ্ণা বুক চিড়ে
বয়ে যাওয়া ধারায়
বুকে ঠাঁই দিয়ে
আপন করেছে কতজনারে
গভীরে গিয়েছি
বিস্ময়ে দেখেছি কষ্ট ব্যথা
বইছো নীরবে,
এই ভেবে ভুলেছি কষ্ট
তবে সইতে পারি না.....

Friday, May 31, 2013

ভালোবাসার দিনে – সৈয়দ শামসুল হক

রাতের অন্ধকার এখন আমার ছবি আঁকার ক্যানভাস ।
তোমার চোখের আলো আমার রঙ ।
একদিন তোমাকে যে ছুঁয়েছি সেই আঙুল আমার তুলি এখন ।
আমি তোমার ঘুমের ছবি আঁকছি ।
তুমি নিলীন হয়ে শুয়ে আছো এখন আমার ছবির ভেতরে।
এই ঘুম থেকে তোমাকে আমি জাগবো না ।

অস্থির পৃথিবী থেকে তুলে এনে ভালবাসার দু’হাতে

তোমাকে এখন আমার স্থিরতার পটে স্থাপন করে চলেছি ।
পৃথিবীর সব রূপসীরা আমার পাশে দাড়িয়ে দেখছে তোমাকে,
আমি তাদের ঈর্ষা দিচ্ছি কেননা তারা স্থিরতা পায় নি ।
আমি একটু পরেই শুয়ে পড়বো তোমার পাশে -
তারপর একটু করে প্রান্তর ভরে উঠবে ঘাষে ।

কালের গ্রহণ লাগা চাঁদ তখন বেরিয়ে এসে

আমাদের দু’জনেরই ছবি আঁকবে- যে দেখবে সে দেখবে ।

আমি থাকবো তোমার অপেক্ষায় – সৈয়দ শামসুল হক

আজ আমি যাব সেখানে,
দিগন্তের শেষ সীমান্তে,
অস্তমিত রবির শেষ আভা
ছোঁয়াবে যেখানে ঠিক সেখানে,
আমি থাকবো তোমার অপেক্ষায়।
গোধূলির লাল টিপ কপালে পরে,
কুয়াশার সাদা চাঁদর গায়ে জড়িয়ে,
বাতাসের দুরন্তপনার কাজল
দৃষ্টির তেপান্তরে এঁকে,
আমি থাকবো তোমার অপেক্ষায়।
গুচ্ছ পাতার মত  বুনন করে
কথামালা উপহার দেব বলে,
সন্ধ্যা প্রদীপের আলোর মত,
মিষ্টি আলো তোমার মনে ছড়াবো বলে,
আমি থাকবো তোমার অপেক্ষায়।।
যেখানে আছি আমি তোমার অপেক্ষায়,
প্রকৃতির  আদল অঙ্গে মেখে,
তোমার জন্য অতি সাধারণ সাজ-সজ্জায়,
এই গোধূলি বেলায়…
একটু উষ্ণ ভালবাসা দেবার একাগ্রতায়,
ঠিক সেখানটায়,
আসবে কি তুমি ?
এই অবেলায়…!!

পরানের গহীন ভিতর (৪) – সৈয়দ শামসুল হক

আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়?-
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান ।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাশীঁর লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়,একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।

Friday, May 17, 2013

হাড়েরও ঘরখানি --- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

মানুষের প্রিয় প্রিয় মানুষের প্রানে
মানুষের হাড়ে রক্তে বানানো ঘর
এই ঘর আজো আগুনে পোড়ে না কেন?

ঘুনপোকা কাটে সে-ঘরের মূল-খুঁটি
আনাচে কানাচে পরগাছা ওঠে বেড়ে,
সদর মহলে ডাকাত পড়েছে ভর দুপুরের বেলা
প্রহরীরা কই? কোথায় পাহারাদার?

ছেনাল সময় উরুত দ্যাখায়ে নাচে
নপুংশকেরা খুশিতে আত্মহারা ।

বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ
বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে
জাতির তরুন রক্তে পুষেছে নির্বীর্যের সাপ-

উদোম জীবন উল্টে রয়েছে মাঠে কাছিমের মতো।

২.
কোনো কথা নেই- কেউ বলে না, কোন কথা নেই- কেউ চলে না,
কোনো কথা নেই- কেউ টলে না, কোন কথা নেই- কেউ জ্বলে না-
কেউ বলে না, কেউ চলে না, কেউ টলে না, কেউ জ্বলে না।

যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা,
ভালবাসাহীন,বুক ঘৃনাহীন, ভয়াবহ ঋন
ঘাড়ে চাপানো-শুধু হাঁপানো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়-
জলে হাতড়ায়, শোকে কাতরায় অতিমাত্রায় তবু জ্বলে না।
লোহু ঝরাবে, সব হারাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?
বুক ফাটাবে, ক্ষত টাটাবে- জাল ছিঁড়বে না ষড়যন্ত্রের?

৩.
আমি টের পাই, মাঝ রাত্তিরে আমাকে জাগায় স্মৃতি-
নিরপরাধ শিশুটির মুখ আমাকে জাগায়ে রাখে
নিরপরাধ বধুটির চোখ আমাকে জাগায়ে রাখে
নিরপরাধ বৃদ্ধটি তার রেখাহীন করতর
আমাকে জাগায়ে রাখে।

মনে পড়ে বট? রাজপথ. পিচ? মনে পড়ে ইতিহাস?
যেন সাগরের উতলানো জল নেমেছে পিচের পথে
মানুষের ঢেউ আছড়ে দোহাই কূলে?
মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না কারো?
কি বিশাল সেই তাজা তরুনের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
যেন ছিঁড়ে নেবে গ্লোব থেকে তার নিজস্ব ভূমিটুকু!

মনে কি পড়ে না ঘন বটমূল, রমনার উদ্যান
একটি কন্ঠে বেজে উঠেছিলো জাতির কন্ঠস্বর?
শত বছরের কারাগার থেকে শত পরাধীন ভাষা
একটি প্রতীক কন্ঠে সেদিন বেজেছিলো স্বাধীনতা।
হাতিয়ারহীন, প্রস্তুতি নেই, এলো যুদ্ধের ডাক,
এলো মৃত্যুর, এলো ধ্বংশের রক্ত মাখানো চিঠি।
গ্রাম থেকে গ্রামে, মাঠ থেকে মাঠে গঞ্জের সুবাতাসে
সে-চিঠি ছড়ায় রক্ত-খবর, সে-চিঠি ঝরায় খুন,
স্বজনের হাড়ে করোটিতে জ্বলে সে-চিঠির সে আগুন।

৪.
ভরা হাট ভেঙে গেল।
মাই থেকে শিশু তুলে নিল মুখ সহসা সন্দিহান,
থেমে গেল দূরে রাখালের বাঁশি, পাখিরা থামালো গান,
শ্মশান নগরী, খাঁ-খাঁ রাজপথে কাকেরা ভুললো ডাক।

প'ড়ে রলো পাছে সাত পুরুষের শত স্মৃতিময় ভিটে,
প'ড়ে রলো ঘর, স্বজনের লাশ, উনুনে ভাতের হাঁড়ি,
ভেঙে প'ড়ে রলো জীবনের মানে জ্বলন্ত জনপদে-
নাড়ি-ছেঁড়া উন্মুল মানুষের সন্ত্রাসে কাঁপা স্রোত
জীবনের টানে পার হয়ে গেল মানচিত্রের সীমা।

৫.
মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না, মনে কি পড়ে না তবু?
গেরামের সেই শান্ত ছেলেটি কী রোষে পড়েছে ফেটে
বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরা সেই বিভীষিকা রাত
সেই ধর্ষিতা বোনের দেহটি শকুনে খেয়েছে ছিড়ে-

মনে কি পড়ে না হাতে গ্রেনেডের লুকোনো বিস্ফোরণ?
তারও চেয়ে বেশি বিস্ফোরণের জ্বালা জ্বলন্ত বুকে
গর্জে উঠেছে শত গ্রেনেডের শত শব্দের মতো।

গেরামের পর গেরাম উজাড় উঠোনে উঠেছে ঘাস।
হাইত্ নের’ পরে ম’রে পড়ে আছে পালিত বিড়াল ছানা,
কেউ নেই, শুধু তেমাথায় একা ব্যথিত কুকুর কাঁদে।

আর রাত্রির কালো মাটি খুঁড়ে আলোর গেরিলা আসে-

৬.
ঝোপে জঙ্গলে আসে দঙ্গলে আসে গেরিলার
দল, হাতিয়ার হাতে চমকায়। হাত ঝলসায়
রোষ প্রতিশোধ। শোধ রক্তের নেবে তখতের
নেবে অধিকার। নামে ঝনঝায়-- যদি জান যায়
যাক, ক্ষতি নেই; ওঠে গর্জন, করে অর্জন মহা ক্ষমতার,
দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার।

৭.
দিন তো এলো না !
পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ছিঁড়ে নেয়া সেই ভূমি
দূর্ভিক্ষের খরায় সেখানে মন্বন্তর এলো ।
হত্যায় আর সন্ত্রাসে আর দুঃশাসনের ঝড়ে
উবে গেল সাধ বেওয়ারিশ লাশে শাদা কাফনের ভিড়ে,
তীরের তরীকে ডুবালো নাবিক অচেতন ইচ্ছায়।

৮.
আবার নামলো ঢল মানুষের
আবার ডাকলো বান মানুষের
আবার উঠলো ঝড় মানুষের

৯.
গ্রাম থেকে উঠে এলো ক্ষেতের মানুষ
খরায় চামড়া- পোড়া মাটির নাহান,
গতরে ক্ষুধার চিন্ মলিন বেবাক,
শিকড় শুদ্ধ গ্রাম উঠে এলো পথে।

অভাবের ঝড়ে-ভাঙা মানুষের গাছ
আছড়ে পড়লো এসে পিচের শহরে ।

সোনার যৌবন ছিলো নওল শরীরে
নওল ভাতার ঘরে হাউসের ঘর,
আহারে নিঠুর বিধি কেড়ে নিলো সব-
সোনার শরীরে বেচে সোনার দোসর ।

দারুন উজানি মাঝি বাঘের পাঞ্জা
চওড়া সিনায় যেন ঠ্যাকাবে তুফান।
আঁধার গতর জেলে, দরিয়ার পুত
বুকের মধ্যে শোনে গাঙের উথাল ।

তাদের অচেনা লাশ চিনলো না কেউ
ঝাঁক ঝাঁক মাছি শুধু জানালো খবর।

বেওয়ারিশ কাকে বলো, কার পরিচয় ?
বাংলার আকাশ চেনে, চেনে ওই জল
আমার সাকিন জানে নিশুতির তারা,
চরের পাখিরা জানে পাড় ভাঙা নদী
আমি এই খুনমাখা মাটির ওয়ারিশ ।

১০.
স্বপ্ন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
স্বজন হারানো মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
ক্ষুধায় কাতর মানুষের ঢল রাজপথে আসে নেমে
পোড়ায় নগরী, ভাঙে ইমারত, মুখোসের মুখ ছেঁড়ে
ছিঁড়ে নিতে চায় পরাধীন আলো প্রচন্ড আক্রোশে।

১১.
আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে
এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে
বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি?
আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?

আর কতো চাস? আর কতো দেবো কতো রক্তের বলী?
প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে কি তোর লাগেনি লোহুর তাপ?
এখনো কি তোর পরান ভেজেনি নোনা রক্তের জলে?

ঝড়ে বন্যায় অনাহারে আর ক্ষুধা মন্বন্তরে
পুষ্টিহীনতা, জুলুমে জখমে দিয়েছি তো কোটি প্রান-
তবুও আসেনা মমতার দিন, সমতা আসেনা আজো।

১২.
হাজার সিরাজ মরে
হাজার মুজিব মরে
হাজার তাহের মরে
বেঁচে থাকে চাটুকর, পা-চাটা কুকুর
বেঁচে থাকে ঘুনপোকা, বেঁচে থাকে সাপ।

১৩.
খুনের দোহাই লাগে, দোহাই ধানের
দোহাই মেঘের আর বৃষ্টির জলের
দোহাই, গর্ভবতী নারীর দোহাই
এ-মাটিতে মৃত্যুর অপচয় থামা

আসুক সরল আলো, আসুক জীবন
চারিদিকে শত ফুল ফুটুক এবার।

১৪.
জাতির রক্তে ফের অনাবিল মমতা আসুক
জাতির রক্তে ফের সুকঠোর সসতা আসুক
আসুক জাতির প্রানে সমতার সঠিক বাসনা ।